অনুগল্প – ওয়াটার মেলন

“ঝিকঝিক ঝিকঝিক” ট্রেন চলছে।

“একশ-তিনশ-চারশো পঞ্চাশ…” আপনমনে আজকের এক্সট্রা রোজগারের হিসেব করছে আন্তঃনগর ট্রেনের কর্মচারী মজনু। টিকেট বিক্রি আর ট্রেনের সিট ব্যবসা মিলিয়ে আজকের দিনের মোট ইনকাম বারো হাজার। এই বারো হাজার টাকার পুরোটা যে তার ভাগে পড়বে এমনটা না। টিকেট চেকারকে দেয়া লাগবে এক হাজার, পুলিশকে চা নাস্তার জন্য আরো এক হাজার।

দশ হাজার টাকা অঙ্কের হিসাবে তেমন বেশি না হলেও মজনু তাতেই সন্তুষ্ট। সে মনে মনে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জানায়। মজনু ওমরাহ হজ্বে গিয়েছিল এ বছর, কয়েক সপ্তাহ আগে দেশে ফিরেছে। হজ্বে গেলে নাকি মানুষের আগের সব পাপ মাফ হয়ে যায়। মজনু যখন তালবিআহ পড়তে পড়তে হারাম শরীফের দিকে যাচ্ছিলো, তখনই প্রতিজ্ঞা করেছে যে তার পাঁচতলা বিল্ডিংটার উপরের অংশের কাজ শেষ হয়ে গেলেই সে আর ঘুষ খাবে না।
বিল্ডিংটা দাড় করানোর জন্যই তো এতো হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম। দালানের কাজ যেদিন শেষ হবে, এর পরেরদিনই মজনু ঘুষ খাওয়া ছেড়ে দিবে। প্রয়োজনে সে দুইবার হজ্ব করে আসবে।

এই ঈদে তার তেমন একটা এক্সট্রা ইনকাম হয় নাই। পাবলিক ইদানিং খুব বেশি লায় পেয়ে গেছে, মাগনা উঠতে চায় ট্রেনে। রেলগাড়ি কি ফ্রি ফ্রি চলে? হাজার ধরণের খরচ আছে একটা রেলগাড়ির পেছনে। সরকারের তো আর অঢেল টাকা না। মূলত: দেশপ্রেম থেকেই মজনু পাবলিক থেকে টাকা তুলে। সে সরাসরি সরকারকে টাকাটা না দিলেও ঘুরেফিরে কিন্তু টাকাটা সরকারের হাতেই যায়। তাছাড়া সে সরকারেরই কর্মচারী, তার হাতে থাকা মানেই সরকারের হাতে থাকা।

সামনে আখাউড়া জংশন। জংশনে বেশ খানিকটা সময় ট্রেন থামে, আবার আস্তে আস্তে ছেড়েও দেয়।
দুইটা দশ-বারো বছরের বাচ্চা ট্রেনে উঠার চেষ্টা করছে। রোগা হাঁড় জিরজিরে, গায়ে নোংরা কাপড়। মজনু ট্রেনের ভেতর থেকে লাথি মেরে একটাকে ফেলে দেয়। লাথি ছেলেটার মুখে লাগে, ছেলেটা মুখ থুবড়ে পরে যায় প্লাটফর্মে।
ফকিরের দল। ভিক্ষা করার জন্য ট্রেনে উঠে। টিকেট ছাড়াই ফকিন্নির বাচ্চাগুলা ট্রেনে উঠতে চায়, যেন ট্রেনটা তাদের বাপের কেনা। টাকার এতই দরকার হলে কাজ করে না কেন? মজনু ভাবে।

পরের স্টেশনে তরমুজের বিশাল উৎসব। মজনু ফাবিনের জন্য একটা বড়সড় দেখে তরমুজ কিনে নেয়। ফাবিন মজনুর একমাত্র ছেলে। এবছর ফাবিন নয়-এ পা দিবে। মাশাল্লাহ খুবই বুদ্ধিমান। তরমুজ তার খুবই প্রিয়। সে তরমুজের ইংরেজি নামও শিখে ফেলেছে – “ওয়াটার মেলন”। ভালোবাসায় মজনুর চোখ ভিজে উঠে।

প্লাটফর্মের ছেলেটাও তরমুজ খায়। তরমুজ তারও খুব প্রিয়। প্রায় প্রতিদিনই সে মনি কাকার তরমুজ ভ্যানের পাশের ফেলে দেয়া পিছগুলো কুড়িয়ে খায়। ভাগ্য প্রসন্ন হলে কখনো লাল অংশও পায়, গতকাল তো প্রায় আস্ত একটা পিছই পেয়ে গিয়েছিল। লাভেই লাভ।

কংক্রিটের আঘাতে ছেলেটার একটা দাঁত ভেঙে গিয়েছে। সে হাসে। ফোকলা দাঁতের হাসি দেখে তার ভাইও হাসে। হাসতে হাসতে লুটোপুটি খায় তারা।

(বাস্তব ঘটনার ছায়া অবলম্বনে)

Ashik Emon

Ashik Emon

Ashik Ishtiaque Emon is a Google-certified Web Performance Expert and LPI-recognized Linux System Administrator. He travels and reads a lot. Reach him at [email protected].

More posts you might like: