ব্যক্তিগত তথ্য এবং গোপনীয়তা সংক্রান্ত কিছু কথা – যে কারণে বাংলাদেশে ইন্টারনেট নজরদারি প্রয়োজন

একজন তথ্য নিরাপত্তা বিশ্লেষক হিসেবে আমি সবসময়ই ব্যক্তিগত তথ্যের গোপনীয়তার পক্ষে এবং রাষ্ট্রীয় সংস্থা কর্তৃক ইন্টারনেটে নজরদারির বিপক্ষে ছিলাম। তবে বাংলাদেশের সমসাময়িক কিছু ঘটনাপ্রবাহ আমার দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে একরকম বাধ্য করেছে।

ইন্টারনেটে গোপনীয়তা

বেশিরভাগ মানুষেরই কোনো না কোনো গোপন তথ্য থাকে যা সে সবার সাথে শেয়ার করতে বিব্রত বোধ করতে পারে। হয়তো তথ্যটি হতে পারে তার ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে কোনো বিব্রতকর ঘটনা, অথবা তার কোনো আপনজন সম্পর্কে।

ইন্টারনেট সবার কাছে সহজলভ্য হওয়ার আগে তথ্যের প্রবাহ ছিল ধীর, তখন ব্যক্তিগত তথ্যের নিরাপত্তাও ছিল অপেক্ষাকৃত সোজা। বেশিরভাগ মানুষই তখন গোপনীয়তা নিয়ে মাথা ঘামাতো না, কারণ ব্যক্তিগত কোনো তথ্য পরিচিত কারো বিশ্বাসঘাতকতা ছাড়া সাধারণত গোপনই থাকতো।

বর্তমানে আমাদের সব ধরণের তথ্যই আদান প্রদান হয় ইন্টারনেটের মাধ্যমে। আমরা এখন না চাইলেও বড় বড় করপোরেশনকে আমাদের তথ্যের একটা অংশীদার বানাই। আমরা যখন ফেসবুকে কারো সাথে কোনো মেসেজ আদান প্রদান করি, ফেসবুক আমাদের দুই পক্ষের মাঝে তৃতীয় একটা পক্ষ হয়ে থাকে। যদিও এখানে অনেক আইনগত বিষয় আছে, তবে সারকথা হলো ফেসবুক চাইলেই আমাদের মেসেজগুলো দেখতে পারে।

ব্যক্তিগত তথ্যের গোপনীয়তা নিয়ে যারা আন্দোলন করেন, তারা মূলত চান তথ্যের গোপনীয়তার নিয়ন্ত্রণ যাতে ব্যবহারকারীর কাছে থাকে।

বাংলাদেশের একজন সাধারণ ইন্টারনেট ব্যবহারকারী

বাংলাদেশে বর্তমানে নয় কোটির বেশি ইন্টারনেট ব্যবহারকারী আছে। এসব ব্যবহারকারীর বেশিরভাগই মোবাইলের মাধ্যমে ইন্টারনেট চালায় এবং শুধু কিছু নির্দিষ্ট ওয়েবসাইটের মাঝেই তাদের ইন্টারনেট সংক্রান্ত জ্ঞান সীমাবদ্ধ।

আমার ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ থেকে বাংলাদেশের বেশিরভাগ ইন্টারনেট ব্যবহারকারীকেই কিছু নির্দিষ্ট শ্রেণীর আওয়ায় নিয়ে আশা যায়:

১. ~৮৫% ব্যবহারকারী: এরা ইন্টারনেট ব্যবহার করে শুধু সামাজিক যোগাযোগ করার জন্য। এই শ্রেণীর বেশিরভাগ ব্যবহারকারী-ই মোবাইল ফোনের মাধ্যমে ইন্টারনেটের সাথে যুক্ত। এরা ফেসবুকে নিউজফিড দেখে, মেসেঞ্জার এবং হোয়াটসএপ এ আড্ডা দেয়, টিকটকে এবং ইউটিউবে গানের বা হাসির ভিডিও দেখে। মাঝেমধ্যে অনেকে তাদের প্রিয় কোনো অনলাইন পত্রিকার ওয়েবসাইটে গিয়ে আপডেট খবর জানে।

এদের বেশিরভাগের ইন্টারনেট জ্ঞানই ব্যবহার করার মাঝেই সীমাবদ্ধ। তারা ইন্টারনেট কিভাবে কাজ করে এসম্পর্কে কোনো জ্ঞান রাখে না।

২. ~১০% ব্যবহারকারী: এরা নিজেদেরকে একটু এলিট শ্রেণীর ব্যবহারকারী মনে করে। এই শ্রেণীর অনেকে বিভিন্ন অনলাইন গেইমিং এর সাথে যুক্ত। অনেকের ফেসবুক ফ্যান পেইজ আছে (বেশিরভাগই ট্রল এবং মিম এর)। এরা মাঝেমধ্যে টিকটক ভিডিও বানায়, এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এরা খুবই এক্সপার্ট। এদের অনেকে ফেসবুক কমার্স (এফ-কমার্স) এর সাথে যুক্ত।

এদের ইন্টারনেট জ্ঞান মোটামোটি ভালোই (যদিও তারা নিজেদেরকে ইন্টারনেট গুরু ভাবে), তবে এদের মাঝে ইন্টারনেট নিয়ে অনেক মিথ কাজ করে।

৩. ~৫% ব্যবহারকারী: এই শ্রেণীর অনেকেই ইন্টারনেট বা কম্পিউটার সম্পর্কিত জীবিকার সাথে যুক্ত। এদের মাঝেও ইন্টারনেট নিয়ে মিথ কাজ করে অনেকক্ষেত্রে, তবে সাধারণ ব্যবহারকারীর চেয়ে এরা ইন্টারনেট সম্পর্কে অনেক বেশি জ্ঞানী।

গুজব সমস্যা এবং “ভার্চুয়াল জগত” সমস্যা

একজন সাধারণ বাংলাদেশির ফেসবুক ব্যবহারের পেছনে অন্যতম একটা মোটিভ থাকে অপরিচিত মানুষের সাথে পরিচিত হওয়া। সব সমস্যার শুরু এখানে থেকেই। হজম করতে হয়তো অনেকের কস্ট হবে, তবে করুণ সত্য হলো – বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম ফেসবুক বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে “ডেটিং সাইটের” মতোন ব্যবহার করে। ফেসবুকের উদ্দেশ্য পরিচিত মানুষের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করা, অপরিচিত মানুষের সাথে পরিচিত হওয়া না।

বাংলাদেশ ঐতিহাসিকভাবেই বেশ রক্ষনশীল সংস্কৃতির। ইন্টারনেট সম্পর্কে এদেশের মানুষের একটা ধারণা (যার জন্য দেশীয় মিডিয়া অনেকাংশেই দায়ী) এরকম যে এটা একটা আলাদা জগত অর্থাৎ “ভার্চুয়াল জগত”। বাস্তব জীবনে যা করা যায় না, এই ভার্চুয়াল জগতে তা করা যায়। অনেক মানুষ তাই যাচ্ছেতাইভাবে এই “ভার্চুয়াল জগত” এর অপব্যবহার করে।

প্রমাণ চাইলে আপনি পরিচিত কোনো বাংলাদেশী মেয়ের ফেসবুক একাউন্টে ঢুকে মেসেজগুলো চেক করলেই বাস্তব প্রমাণ পাবেন। প্রেম প্রত্যাশী অপরিচিত মানুষেরা প্রতিনিয়ত এই “ভার্চুয়াল” জগতে প্রেমের পেছনে ছুটে, বাস্তব জীবনে হয়তো যাদের অনেকেই সামাজিকভাবে অসম্ভব ভদ্র (আমার দৃষ্টিতে ভদ্রতার মুখোশ মাত্র)।

যেহেতু এদেশের সিংহভাগ ব্যবহারকারী ইন্টারনেট সম্পর্কে কোনো জ্ঞান রাখে না, তাই তারা ফেসবুকের নিউজফিডে যা পড়ে তার সবকিছুই বেদবাক্য হিসেবে বিশ্বাস করে। যারা ইন্টারনেট সম্পর্কে একটু-আধটু ধারণা রাখেন তারা সম্ভবত বুঝতে পারছেন এটা কতটা ভয়াবহ।

ফেসবুকে ভূয়া খবর বা গুজব অনেকটা ভাইরাসের মতোন। কোন খবর যে সঠিক, আর কোন খবর যে ভূয়া বা স্বার্থান্বেষী মহলের গুজব সেটা যাচাই করার মতোন ইন্টারনেট জ্ঞান ৮৫% এর বেশি বাংলাদেশী ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদেরই নেই। তাই, যখন পরিচিত কেউ একজন কোনো গুজব “শেয়ার” করে, মিনিটের মাঝেই তা ছড়িয়ে পড়ে অন্যান্য ফেসবুক ব্যবহারকারীদের টাইমলাইনে।

বাস্তব জীবনে হয়তো মেয়েদেরকে উত্যক্ত করার আগে অথবা কোনো ভূয়া খবর বিশ্বাস করার এবং ছড়িয়ে দেয়ার আগে মানুষ কয়েকবার চিন্তা করতো। কিন্তু যেহেতু “ভার্চুয়াল” জগত, তাই মানুষ কোনো কিছু করার আগে দুইবার চিন্তা করে না। তারা ভাবে যে এই জগতে কিছু করলে তাদের কোনো শাস্তি হবে না। বাস্তব জীবনে যে এই “ভার্চুয়াল” জগত কোনো প্রভাব ফেলতে পারে, সেটা অনেকেই বুঝে না।

পরিত্রাণের উপায়

সবার আগেই যা মাথায় আসে, তা হলো এই ব্যবহারকারীদেরকে ইন্টারনেট সম্পর্কে আরো বেশি শিক্ষিত করে তোলা।

কিন্তু মাথায় রাখতে হবে, অন্যান্য যেকোনো উন্নত দেশের চেয়ে আমাদের দেশের ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা অনেক বেশি। এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে ইন্টারনেটের মতোন জটিল একটা বিষয় সম্পর্কে শিক্ষিত করে তোলা এবং তাদের বহুদিনের অভ্যাস নির্মুল করা চাট্টিখানি কথা নয়।

তাই আমাদেরকে দুই ধাপে এই সমস্যার সমাধান করতে হবে। প্রথমত, সরকার দেশের মানুষকে ইন্টারনেটে গুজব কিভাবে ছড়ায় সে সম্পর্কে ক্যাম্পেইন এর মাধ্যমে অবহিত করতে পারে। অনেক মানুষ, যাদের ফেসবুক সম্পর্কে বিশেষ কোনো জ্ঞান নেই, তারা এই ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে এ সম্পর্কে জানতে পারবে এবং গুজবে বিশ্বাস করার আগে দ্বিতীয়বার ভাববে।

দ্বিতীয়ত, দায়ী অনলাইন পোর্টালগুলোকে বন্ধ করে দিতে হবে এবং দেশের ইন্টারনেট (বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম) এর উপর অন্তত সাময়িকভাবে নজরদারি বাড়াতে হবে। যেসব মানুষ কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে গুজব ছড়ায় অথবা কাউকে হেনস্থা করে, তাদেরকে শাস্তির আওতায় আনতে হবে। ইন্টারনেটে নজরদারী বাড়ানোর মাধ্যমে অপরাধী শনাক্ত এবং বিচারের আওতায় নিয়ে আসাও সহজ হবে।

কিন্তু গোপনীয়তার কি হবে?

বাংলাদেশের ইন্টারনেট ব্যবহারকারীরা এখনো প্রিমিটিভ ধাপেই আছে। ব্যক্তিগত তথ্যের গোপনীয়তা অবশ্যই প্রয়োজনীয়, কিন্তু এখনই নয়। দেশের মানুষ যখন দায়িত্বপূর্নভাবে ইন্টারনেট ব্যবহার শিখবে, ব্যক্তিগত তথ্যের নিরাপত্তা তখনই প্রযোজ্য হবে, এর আগে নয়।

Ashik Emon

Ashik Emon

Ashik Ishtiaque Emon is a Google-certified Web Performance Expert and LPI-recognized Linux System Administrator. He travels and reads a lot. Reach him at [email protected].

More posts you might like: